_এল নিনো হল একটি বিরূপ প্রভাপন্ন জলবায়ু প্রক্রিয়া যা পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তৈরি করতে সাহায্য করে। প্রতি দুই থেকে পাঁচ বছর পর এল নিনো আবার আবির্ভূত হয় এবং কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক বছর স্থায়ী হয়। এটি পৃথিবীর একটি নিয়মিত ঘটমান জলবায়ু বৈশিষ্ট্য।
ইউএস ক্লাইমেট মনিটরিং এজেন্সির দেয়া তথ্য অনুসারে, আরেকটি এল নিনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যেটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এল নিনোর রয়েছে সারা বিশ্বের আবহাওয়াকে প্রভাবিত করতে পারার মতো ক্ষমতা।
৯৫% এরও বেশি সম্ভাবনা রয়েছে যে প্রক্রিয়াধীন এল নিনোটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত উত্তর গোলার্ধের শীতকালে অব্যাহত থাকবে, একজন মার্কিন সরকারের পূর্বাভাসকারীর মতে এর প্রভাবে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে।
এল নিনো কি
এল নিনো হচ্ছে পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বৃদ্ধি পাওয়া, এবং এটি দাবানল থেকে শুরু করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, এমনকি দীর্ঘায়িত খরাসহ বিভিন্ন বিরুপ আবহাওয়ার জন্ম দিতে পারে। এল নিনো সৃষ্টিকারী উষ্ণ জল সাধারণতঃ নন-এল নিনো বছরগুলিতে ইন্দোনেশিয়ার কাছাকাছি অবস্থান করে থাকে। এল নিনো চলাকালীন সময়ে পানি পূর্ব দিকে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে সরে যায়।
দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে উচ্চ সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা টানা পাঁচ মাস অস্বাভাবিকভাবে উষ্ণ থাকলে, এই অবস্থাটিকে এল নিনো হিসাবে বিবেচিত করা হয়।
এল নিনোর প্রভাবে উক্ত অঞ্চলে সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটায়, এবং প্রশান্ত মহাসাগরের কাছাকাছি উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল জুড়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়।
এবছরের জুলাই মাসে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এই মর্মে সতর্ক করে যে, গত সাত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে এল নিনোর আবির্ভাব হওয়ার পরে বিশ্বের বড় অংশে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে।
প্রভাব
১৯৬৫-১৯৬৬, ১৯৮২-১৯৮৩ এবং ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে এল নিনো ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মেক্সিকো ও চিলি পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য বন্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছিল। এই প্রভাব পূর্ব আফ্রিকার মতো প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বহুদূর পর্যন্ত অনুভূত হয়, যেখানে প্রায়ই কম বৃষ্টিপাতের কারনে নীল নদে জলপ্রবাহ কমে যায়।
শক্তিশালী লা নিনা’র সংঘটনগুলিই মূলতঃ এল নিনো হিসাবে জলবায়ুর বিপরীত প্রভাবের জন্য দায়ী। ১৯৮৮ সালে একটি বৃহৎ লা নিনা উত্তর আমেরিকা জুড়ে উল্লেখযোগ্য খরা সৃষ্টি করেছিল।
দক্ষিণ আমেরিকানরা শত শত বছর ধরে এল নিনোর প্রভাব প্রত্যক্ষ করে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তন এই এল নিনো এবং লা নিনার প্রভাবকে আরও শক্তিশালী ও ব্যাপক করে তুলতে পারে।
চলমান এল নিনো’টির প্রভাবে দক্ষিণ গোলার্ধের যেসব এলাকায় ফসল উৎপাদিত হয়, আসন্ন ক্রমবর্ধমান ঋতুতে সেখানে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, এই তালিকার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রাজিল, যেখানে আবহাওয়া সাধারণত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শুষ্ক এবং উষ্ণ থাকে।
এল নিনো চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশে শীতল এবং আর্দ্র আবহাওয়া দেখা গিয়েছে, যখন এর পশ্চিম অংশ এবং কানাডার কিছু অংশ উষ্ণ এবং শুষ্ক থাকে। পাশাপাশী হারিকেনের কার্যকলাপ সাধারণতঃ আটলান্টিকে হ্রাস পায়, এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়গুলি বৃদ্ধি পায়।
অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া ব্যুরো জানিয়েছে, এল নিনোর সূচকগুলি পূর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হয়েছে এবং আবহাওয়ার বৈরিতা সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে শুরু হতে পারে, যা অস্ট্রেলিয়ায় আরও গরম এবং শুষ্ক পরিস্থিতি নিয়ে আসবে।
এল নিনো আবহাওয়ার প্রভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আর্থ-সামাজিক ক্ষতির ব্যপক সম্ভাবনা রয়েছে। এর আরেকটি প্রভাব রয়েছে যা গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পৃষ্ঠে অতিরিক্ত তাপের কারণে ঘটে, এটি বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপাদন করে যা সাময়িকভাবে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে।
এল নিনোর একটি অনুরূপ ধরন ১৯০০ এর দশকের গোড়ার দিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল যেটিকে ‘দক্ষিণ দোলন’ বলা হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে দুটি ধরনকেই প্রায় একই প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং তাই কখনও কখনও এল নিনোকে এল নিনো/দক্ষিণ দোলন বা ENSO নামে অভিহিত করা হয়।
এল নিনো কীভাবে সংঘটিত হয়
গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে, সমুদ্রের বিস্তীর্ণ অংশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত যে ধারাবাহিক বাতাস দেখা যায় তাকে 'বাণিজ্য বায়ু' বলা হয়। এই বায়ুগুলি তাদের গতিপথের দিকে পৃষ্ঠের কাছাকাছি উষ্ণ জলকে ঠেলে দেয়, ফলস্বরুপ এই উষ্ণ জল এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার চারপাশের মহাসাগরের পশ্চিম দিকে জমা হয়।
একপর্যায়ে দক্ষিণ এবং মধ্য আমেরিকার চারপাশের সমুদ্রের অন্য দিকে উষ্ণ জল উপকূল থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে ঠান্ডা জল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় যা সমুদ্রের গভীরে অর্থাৎ নীচের দিকে সরে যায়, এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় আপওয়েলিং। এতে গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হয়, এবং উষ্ণ জল পশ্চিমে এবং শীতল জল পূর্বে সরে যায়।
উষ্ণ জল বাতাসেও অতিরিক্ত উত্তাপ যোগ করে যার ফলে বাতাসের গতি জোরালোভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এই ক্রমবর্ধমান বায়ু বৃষ্টিপাতের ঘন মেঘের সাথে আরও অস্থির আবহাওয়ার একটি ক্ষেত্র তৈরি করে।
পশ্চিমের এই ক্রমবর্ধমান বায়ু সমুদ্রের একদিকে উষ্ণ আর্দ্র বায়ু এবং অন্য দিকে শীতল শুষ্ক বায়ু নেমে আসার সাথে পৃথিবীর এই অংশ জুড়ে বায়ুমণ্ডলীয় সঞ্চালন স্থাপন করে। এই প্রক্রিয়া পূর্বদিকের বাতাসকে আরও শক্তিশালী করে, যেকারনে এল নিনো শুরু না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বের এই অংশটি একটি স্ব-স্থায়ী অবস্থায় থাকে।
সবকিছু ঠিক থাকলে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় আবহাওয়া ব্যবস্থা বা বিষুবরেখার চারপাশে সমুদ্রের ধীরগতির পরিবর্তন, ঘটনাগুলির একটি ধারাবহিকতা তৈরি করার সম্ভাবনা রাখে যা স্বাভাবিক বাণিজ্য বায়ুকে দুর্বল বা এমনকি বিপরীত করে দিতে পারে। দুর্বল বাণিজ্য বাতাসের সাথে সাগরের পশ্চিম দিকে উষ্ণ পৃষ্ঠের জলের স্পর্শ বা সংঘর্ষ কম থাকে এবং পূর্ব দিকে ঠান্ডা জলের উৎপত্তি হয়।
এটি সমুদ্রের অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা অংশগুলিকে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পার্থক্য দূর করে উষ্ণ করতে থাকে। পাশাপাশী উষ্ণতম জল সমৃদ্ধ অংশ সরে গিয়ে সংশ্লিষ্ট আর্দ্র এবং অস্থির আবহাওয়াও তৈরি করে।
ফলশ্রুতিতে নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরে বৃষ্টিপাতের জলের ধরণ ও বৃহৎ আকারের বাতাসের ধরণগুলি পরিবর্তীত হয়। বাতাসের এই পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবন যাপনে প্রভাব ফেলে।